একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ চৈ পড়ে গেল। কেউ একজন গত রাতে যীশুখ্রীষ্ট এর প্রস্তর নির্মিত প্রতিমূর্তির নাক ভেঙ্গে দিয়েছে। খ্রীষ্টান উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তারা ধরে নিল যে, এটা একমাত্র মুসলমানেরই কাজ।
খ্রীষ্টান নেতারা মুসলিম সেনাপতি আমরের কাছে এলো বিচার ও অন্যায় কাজের প্রতিশোধ দাবী করতে। আমর সব শুনলেন। শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তিনি প্রতিমূর্তিটি সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরী করে দিতে চাইলেন। যীশুখ্রীষ্ট
কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ নেবার বাসনা ছিল অন্যরূপ। তাদের সংকল্প প্রকাশ করে একজন খ্রীষ্টান নেতা বললো, “যীশুখ্রীষ্টকে আমরা আল্লাহর পুত্র মনে করি। তাঁর প্রতিমূর্তি এরূপ অপমান হওয়াতে আমরা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছি। অর্থ এর যথেষ্ঠ ক্ষতিপূরণ নয়। আমরা চাই আপনাদের নবী মুহাম্মদের (সাঃ) প্রতিমূর্তি তৈরী করে ঠিক অমনি ভাবে অসম্মান করি।” এ কথা শুনে বারুদের মত জ্বলে উঠলেন আমর (রা), ভীষণ ক্রোধে মুখমণ্ডল উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে সংযত করে নিয়ে তিনি খ্রীষ্টান বিশপকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি তাতে রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
খ্রীষ্টান নেতারাও সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। যীশুখ্রীষ্ট
পরদিন খ্রীষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রা) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন,
“এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আপনাদের তাতে আমার শাসন দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহন করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।”যীশুখ্রীষ্ট
এ কথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষ্ণধার তরবারি হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রীষ্টানরা স্তম্ভিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সাহসা সেই নীরবতা ভংগ করে একজন মুসলিম সৈন্য এলো।
চিৎকার করে বলল,
“আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোন দোষ নেই। আমিই মূর্তির নাসিকা কর্তন করেছি, এই তা আমার হাতেই আছে!”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারির নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিল। স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে। যীশুখ্রীষ্ট
বিশপের আন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তরবারি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিশপ বললেন,
“ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের সেই মুহাম্মদ যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মত মহৎ, উদার, নির্ভীক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যীশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা অন্যায় হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতে অন্যায় হবে যদি আজ আমি এই সুন্দর ও জীবন্ত দেহের অঙ্গহানি করি। সেই মহান আদর্শ নবীকেও আমার সালাম জানাই।”
আরো পড়ুন : হারানো মসজিদ : ১৩৭৭ বছর পুরোনো লালমনিরহাটের ‘হারানো’ মসজিদ
হারানো মসজিদ : লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামটি খুবই শান্ত ও শীতল। দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতের সারি। কিছু দূরে দু-একটি আবাসিক বাড়ি। কোলাহল নেই, ভিড় নেই। প্রশ্ন হলো, হাজার বছর আগে কি এই গ্রামে কোনো বসতি ছিল? নাকি মুসলিম সম্প্রদায়ের এখানে আগমন কবে?
হারানো মসজিদ : এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় ১৯৮৬ সালে। ইতিহাসের হারানো অধ্যায় লুকিয়ে ছিল সেই প্রত্যন্ত গ্রামের ‘আড়া’তে। স্থানীয়রা আরা বলতে জঙ্গল ও ঝোপঝাড়কে বোঝায়। জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় কিছু প্রাচীন ইট বেরিয়ে এল। মাটি ও ইট অপসারণ করতে গিয়ে মসজিদের ভিত্তি পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটা হলো, এ ধরনের পোড়া মাটির স্থাপত্য বাংলাদেশে এর আগেও পাওয়া গেছে। তাহলে বিশেষত্ব কোথায়? কে বা কারা এই মসজিদ নির্মাণ করেছে তা নিয়ে রহস্য। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেই পোড়া মাটির ট্যাবলেটগুলির কার্বন ডেটিং করে নিশ্চিত করেছেন যে সেগুলি 690 খ্রিস্টাব্দ বা 69 হিজরির কাছাকাছি নির্মিত হয়েছিল। মানে এটি এক হাজার ৩৭৭ বছরের পুরনো মসজিদ!
মসজিদের চূড়ায় প্রাপ্ত পাথরে স্পষ্ট লেখা ‘লা লাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর পূর্বে, হিজরি ৬৯’। খননের ফলে পরবর্তী মসজিদ মেহরাব এবং মসজিদ-সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও মিম্বরও পাওয়া গেছে। লেখক নিজের জন্য এই মসজিদের নাম দিয়েছেন ‘হারনো মসজিদ’।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সাহাবী হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) এই অঞ্চল দিয়ে চীনে হিজরত করেন। চীনের এখন বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর তীরে কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল দাবি করেছেন যে আরব ও রোমান বণিকদের বাণিজ্য বহর সিকিম থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার তীরে খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে চলে যাওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া এই মসজিদটি হয়তো ছাহাবী আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মাণ করেছিলেন।
যাইহোক, 690 খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদের নির্মাণ আশ্চর্যজনক নয় কারণ বাংলায় সভ্যতার বিকাশ খ্রিস্টাব্দের 500 বছর আগে হয়েছিল, যা প্রাচীন রোমান, গ্রীক এবং পারস্যের সাথে তুলনীয়। এই মসজিদ নির্মাণের সময় বাংলা খড়গ রাজবংশের শাসনাধীন ছিল; যারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের উত্থান-পতনে রামদাস গ্রাম জনবসতিহীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশরা এই এলাকাটিকে একটি সামরিক ঘাঁটি এবং লালমনিরহাটে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি তৈরি করায় অনেক স্থানীয় লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।ফলে জনবসতিহীন গ্রামের মসজিদের ধ্বংসাবশেষ জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগণের কাছে এই এলাকাটি ‘মোস্টার আরা’ নামে পরিচিতি পায়, যার অর্থ বনের মসজিদ। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের মাধ্যমে এই নামের তাৎপর্য স্পষ্ট হয়।
মসজিদের ধ্বংসাবশেষ যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে তারা একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সপ্তদশ শতাব্দীর সমসাময়িক বাংলা ও আরব স্থাপত্যের রেফারেন্স দিয়ে একটি কাল্পনিক মসজিদের মডেল তৈরি করা হয়েছে।বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নাও থাকতে পারে, তবে ঐতিহাসিক রেফারেন্স রেখে মসজিদের কাল্পনিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই মসজিদের নাম ‘হারানো মসজিদ’।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং ‘হারানো মসজিদ কমিটির’ সাথে যুক্ত একাধিক ব্যক্তিদের মতে, ধ্বংস হওয়া মসজিদটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একজন সাহাবী নির্মাণ করেছিলেন।